নামকরা স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক এখন অটোচালক

নামকরা স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক এখন অটোচালক

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস অনেকের জীবনের গল্পের ধারা উলট-পালট করে দিয়েছে। কেউ মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, কেউ হারিয়েছেন স্বজন। আবার কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখেছেন। তবে যারা করোনার কারণে চাকরি হারিয়েছেন তাদের জীবনের গল্পটা ভিন্ন। তারা বাস্তব জীবনের চরম নির্মমতায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

এদেরই একজন মো. মাহাবুর রহমান। গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার নামকরা একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার নয়াপাড়া গ্রামে। তিনি শ্রীপুর পৌরসভার বেড়াইদেরচালার লিচুবাগান এলাকায় রফিকুল ইসলামের বাড়িতে ভাড়া থেকে এখন অটোরিকশা চালাচ্ছেন।

স্নাতক শেষ করে ২০১৪ সাল থেকে কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও বাড়ি গিয়ে টিউশনি করে যা উপার্জন হতো তাই বৃদ্ধ মা, বাবা, স্ত্রী, আড়াই বছর বয়সী এক কন্যা সন্তান ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ভাইয়ের পেছনেই খরচ করতেন।

তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন বাধ্য হয়ে ভাড়ায় অটোরকিশা চালাচ্ছেন এ শিক্ষক। মঙ্গলবার বিকেলে তার সঙ্গে কথা হয় শ্রীপুর পৌরসভার মাওনা চৌরাস্তা এলাকায়। প্রায় ঘণ্টাখানেকের আলাপচারিতায় করোনাকালীন তার দুর্বিসহ জীবনের কথা জানান তিনি।

মাহাবুর রহমান জানান, দেশে প্রথম করোনাভাইরাস দেখা দেয়ার সময় তিনি শ্রীপুরের সুলতান উদ্দিন মেমোরিয়াল একাডেমিতে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকতা করতেন। সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনের মধ্যে বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হলে তাকে কর্মহীন হয়ে পড়তে হয়। পরে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়ের খোলার আশ্বাস দিলেও সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক আর খোলা হয়নি। শিক্ষকতা ও টিউশনি বন্ধ, উপার্জন হারানো মাহাবুরের চার মাসের ঘর ভাড়া বাকি রয়েছে।

বাড়ির মালিক তাকে ভাড়া পরিশোধের জন্য চাপ দিলে তিনি বাবার গরু বিক্রি করে এনে ভাড়া পরিশোধ করে দিয়ে গ্রামে চলে যান। সেখানে কর্মহীন হয়ে পড়া মাহাবুর মাস খানেক পর এক বন্ধুর পরামর্শে গাজীপুরের শফিপুর এলাকায় একটি গার্মেন্টেসে ৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন। আট মাস চাকরি করার পর সন্তানের অসুস্থতায় সেই চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। পরে বিভিন্নজনের কাছে ঘুরেও কাজ জোগাড় করতে না পেরে মাস দুয়েক আগে থেকে এক পরিচিত ভাই ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে দৈনিক ৪০০ টাকা হাজিরায় তাকে একটি অটোরিকশা কিনে দেন। এখন এই অটোরিকশাই মাহাবুরের একমাত্র উপার্জনের উৎস।

তিনি আরও বলেন, করোনায় কর্মহীন হয়ে যাওয়ার পরপরই ব্যবসা করার পরিকল্পনা ছিল। তিনি ২০ হাজার টাকায় কিছু কাপড় কিনে তা বিক্রি শুরু করেন। লকডাউনে দোকান বন্ধ থাকায় সেগুলো আর বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও নানাজনের কাছে চাকরির জন্য ঘুরে ঘুরে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়লে কাঁচা মালের ব্যবসা শুরু করার চিন্তা করেন। কিন্তু ব্যবসা শুরুর নিরাপত্তা জামানত না থাকায় সেই ব্যবসা থেকেও তিনি পিছু হটেন।

প্রায় মাস খানেক যাবত মাহাবুর অটোরিকশা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমার তো আর শিক্ষকতা পেশায় ফেরার সুযোগ নেই। কারণ অনেকেই জেনে গেছেন আমি অটোরিকশা চালাই। একজন অটোরিকশা চালককে কি কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবে। অভিভাবকরা তো বলবেন একজন অটোরিককশা চালক তার সন্তানকে কি শেখাবেন? করোনার শুরুতে পকেট একদম খালি ছিল।  সন্তানের অসুস্থতা ও বাড়ি ভাড়া, দোকান বাকি পরিশোধ করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। অনেকেরই নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে তাকে। একপর্যায়ে তার বাবা তাকে গরু বিক্রি কিছু টাকা পাঠালে তিনি বকেয়া পরিশোধ করে সন্তানের চিকিৎসা করান।

শ্রীপুর উপজেলা কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েনের সাধারণ সম্পাদক ও সুলতান উদ্দিন মেমোরিয়াল একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সালাহ্ উদ্দীন আহমেদ মিলন জানান, শ্রীপুর উপজেলার পাঁচ শতাধিক বিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষক এরকম মানবেতর জীবন যাপন করছে। করোনায় বেসরকারি শিক্ষকদের বাস্তব জীবনের চরম নির্মমতা শিখিয়ে দিয়েছে। তাই অবিলম্বে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়ার দাবি জানান তিনি।

আপনি আরও পড়তে পারেন